ওয়েব ডেস্ক, বিপ্লবী সব্যসাচী পত্রিকা অনলাইন : বন দফতরের কাজের পর্যালোচনা করতে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় আসছেন রাজ্যের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বন বিভাগের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ সঠিক ভাবে হচ্ছে কি না, কোথায় ঘাটতি রয়েছে সে বিষয়ে তদারকির জন্যই জেলায় বনমন্ত্রী আসছেন। তার আগে বিভিন্ন রেঞ্জ অফিসারদের নিয়ে প্রস্তুতি বৈঠকও হয়েছে মেদিনীপুর বনবিভাগে। সম্প্রতি গাছ পাচার রুখতে কড়া বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
জঙ্গল থেকেও পাচার হয়েছে শাল গাছ। জোর নজরদারির নির্দেশ বন দফতরকেও। তারপরই জেলায় বহু বেআইনি কাঠ চেরাই মিল সিল করে বন দফতর। পাশাপাশি জঙ্গলে গাছ কেটে পাচার রুখতে বন সুরক্ষা কমিটিগুলিকে আরও সক্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছে বন দফতর। ‘জয়েন্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট’ অর্থাৎ যৌথ বন পরিচালনার কাজকর্ম কেমন চলছে তা জানতে এবং তার উপর আলোচনায় অংশ নিতে পারেন রাজ্যের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক।
থাকবেন প্রতিমন্ত্রী বীরবাহা হাঁসদা সহ বন দফতরের বিভিন্ন আধিকারিকরা। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২৭ জুন মেদিনীপুর শহরে শহিদ প্রদ্যোৎ স্মৃতি সদনে বৈঠকে উপস্থিত হবেন বনমন্ত্রী। জানা গিয়েছে, ওই দিন একাধিক দাবি নিয়ে বনমন্ত্রীকে স্মারকলিপিও জমা দিবে বনকর্মীদের সংগঠন। ইতিমধ্যে মেদিনীপুর বনবিভাগের বহু রেঞ্জ ও বীট অফিস আধিকারিক শূন্য।
ফরেস্ট গার্ডের সংখ্যাও হাতেগোনা। ফলে বনমন্ত্রীর কাছে বনকর্মী নিয়োগ, প্রতিটি অফিসে গাড়ির ব্যবস্থা, বেতন কাঠামো সহ একাধিক দাবি জানানো হতে পারে। বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বৈঠকে মূল আলোচ্য বিষয় ‘জয়েন্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট’। এই ‘যৌথ বন পরিচালনা’ সারা দেশে নজির সৃষ্টি করেছে শালবনীর আড়াবাড়ি। দেশের বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বনাঞ্চল টিকে থাকার পথ দেখিয়েছিল।
মেদিনীপুর বনবিভাগে বর্তমানে কি অবস্থা ‘জয়েন্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট’-এর, বনমন্ত্রী তারও খোঁজ নিতে পারেন বলে সূত্রের খবর। বন দফতর থেকে জানা গিয়েছে, মেদিনীপুর বনবিভাগে কমিটির সংখ্যা ২৮০ টি, তার মধ্যে সক্রিয় প্রায় ১৯০ টি। বাকিদের সক্রিয় করার চেষ্টা চালাচ্ছে বন দফতর। এই কমিটিগুলি সক্রিয় না হলে বন ও বন্যপ্রাণ রক্ষা করা সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন অনেকে। উল্লেখ্য, ৭০ এর দশকে ধ্বংস হতে বসেছিল মেদিনীপুর বনবিভাগের আড়াবাড়ি বনাঞ্চলটি।
সেই জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়ায়। আর সেই ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে ছিলেন তৎকালীন মেদিনীপুরের ডিএফও অজিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। বনবাসী এবং জঙ্গলের অধিকার, দুই দ্বন্দ্বের সমাধানের পথ খুঁজে দিয়েছিলেন অজিতবাবু। সেই সঙ্গে জঙ্গলরক্ষার নতুন চিন্তাও। সেইসময় বনাঞ্চল এলাকার বাসিন্দারা জ্বালানি ও ঘর তৈরির জন্য জঙ্গলের গাছ নির্বিচারে কেটে ফেলেছিলেন। এভাবে চলতে থাকলে নিমেষে শেষ হয়ে যাবে জঙ্গল। ব্যাপক ক্ষতি বাস্তুতন্ত্রে। এর থেকে মুক্তির উপায় বের করলেন ডিএফও।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সাহায্য ছাড়া নতুন বনাঞ্চল তৈরি তো দূরের কথা যেটুকু অবশিষ্ট আছে সেটুকু রক্ষা করা অসম্ভব বলে মনে করলেন তিনি। সেই মতো বাস্তবে প্রয়োগ ঘটানোর উদ্যোগী হলেন। শুরু হলো মানুষজনকে জঙ্গলের প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর। পায়ে হেঁটে ঘুরে ঘুরে জঙ্গলের মানুষদের নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করলেন। তাঁদের বোঝাতে শুরু করলেন, জঙ্গল বেঁচে থাকলে তাঁরাও বেঁচে থাকবেন। গাছ রক্ষা করলে সেই গাছ বিক্রির পরে লাভের টাকার চার ভাগের এক ভাগ গ্রামবাসীরাই পাবেন।
গাছ লাগানোর সময় কাজ পাবেন। জ্বালানিও পাবেন। কিন্তু মুখের কথা তখনও স্থানীয়দের অনেকে বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। সেইসময় কেন্দ্রীয় সরকারের সামাজিক বন সৃজন প্রকল্পও শুরু হয়েছে। ওই প্রকল্পে নতুন নতুন বনাঞ্চল তৈরি শুরু হল। পড়ে থাকা পতিত জমিতে গাছ লাগানোর কাজে স্থানীয়দের ব্যবহার করা হল। তৈরি হল আড়াবাড়ি সামাজিক বন সুরক্ষা কমিটি। বনাঞ্চল লাগোয়া ১১টি গ্রামের ৬১৮টি পরিবারকে যোগ করা হল কমিটিতে। বর্তমানে ওই কমিটিতে ১১৩৮ টি পরিবার রয়েছে।
প্রায় কাজ পাওয়ায় গাছ রক্ষার বার্তা দিলেন গ্রামবাসীরা। জানা গিয়েছে, ১৯৭২ সালে শুরু হয়েছিল আড়াবাড়িতে জঙ্গল বাঁচানোর লড়াই। সাফল্য এসেছে ১৯৮৭ সালে। ওই বছরেই জঙ্গলের একটি অংশের কাঠ বিক্রি হয়। লভ্যাংশের ২৫ শতাংশ সমান ভাবে বণ্টন হল কমিটির পরিবারগুলির মধ্যে। তারপর আরও উৎসাহ বাড়লো কমিটির। জঙ্গলের কিছু সম্পদের ওপরে অধিকার, জ্বালানির জোগান, পশুচারণের জায়গা পেলেন গ্রামবাসীরা।
অজিতবাবুর হাত ধরে আড়াবাড়ির সাফল্যে উৎসাহিত কেন্দ্রীয় সরকার। আড়াবাড়ি মডেল প্রয়োগ করা হয় বিভিন্ন রাজ্যে। ১৯৯০ সালে মডেলটি সারা দেশে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। দেশের বাইরেও এই মডেল কার্যকরী হয়েছে। এখনও আড়াবাড়ি মডেল নিয়ে খোঁজখবর নিতে আসেন পরিবেশকর্মী, বন নিয়ে কাজ করা মানুষজন। এমনকি বিভিন্ন রেঞ্জ অফিসাররা প্রশিক্ষণের সময় ঘুরে যান আড়াবাড়ি।
জঙ্গল বাঁচানো-সহ নানা কাজেই এই কমিটিকে ব্যবহার করা হয়। জঙ্গলে অনধিকার প্রবেশ, অন্যায় ভাবে জঙ্গল দখল, আগুন লাগানো, শিকার, চুরি প্রভৃতি কাজে বাধা দানের মাধ্যমে বন ও বন্যপ্রাণী সুরক্ষা নিশ্চিত করার কাজ ‘জয়েন্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট’ কমিটির। কোন অপরাধ সংগঠনকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের আটক করা বা আটক করতে বনকর্মীদের সাহায্য করা এবং মানুষ ও বন্যপ্রাণী সংঘাত কমাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করাও কমিটির কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
পাশাপাশি এলাকা থেকে হাতি সরানোর সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে কমিটির সদস্যদের। বন কমিটিকে এখন ৪০ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়া হয় কাঠ বিক্রি থেকে। লভ্যাংশের পরিমাণ বাড়লেও সক্রিয় ভূমিকা কমেছে কমিটিগুলির! সম্প্রতি জঙ্গল থেকে রাতের অন্ধকারে পাচার হয়েছে শাল গাছ। কিছু এলাকায় স্থানীয় মানুষজন কেটে ফেলছেন। বন্যপ্রাণ শিকার আটকানো এবং হাতি তাড়ানোর সময়ও বেশকিছু কমিটির সহযোগিতা মেলে না বলে জানা গিয়েছে।
ফলে হাতেগোনা কয়েকজন বনকর্মী নিয়ে জঙ্গল রক্ষা বা হাতি সরানো যে সম্ভব নয় স্থানীয়দের সহযোগিতা ছাড়া, তা মানছেন বন দফতরের এক আধিকারিক। কেন সক্রিয় ভূমিকা দেখা যাচ্ছে ওই কমিটিগুলিতে? মেদিনীপুর বনবিভাগের কমিটির এক সদস্য বলেন, “আগের থেকে কাজ কমেছে। টাকাও সময়ে মেলে না। হাতির হানায় ক্ষতির ক্ষতিপূরণ কবে যে মিলবে তার ঠিক নেই। মানুষের ক্ষোভ বেড়েছে। পাশাপাশি আধিকারিক ও বনকর্মী কম থাকায় নিবিড় যোগাযোগ কমেছে স্থানীয়দের সঙ্গে। ফলে আগের মতো কাজে উৎসাহ পাচ্ছে না।”
লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ- https://www.facebook.com/biplabisabyasachi
Midnapore Forest Department
– Biplabi Sabyasachi Largest Bengali Newspaper In Midnapore