ওয়েব ডেস্ক, বিপ্লবী সব্যসাচী পত্রিকা অনলাইন : সালটা ছিল ২০১২। ঘাটালের মনোহরপুর -২ গ্রাম পঞ্চায়েতের গোপমহল এলাকায় তখন চলাই মদ উৎখাতের বিরুদ্ধে চলছে বিরাট আন্দোলন। উদ্দেশ্য বর্ণপরিচয়ের স্রষ্ঠা বিদ্যাসাগরের এই এলাকা থেকে চোলাই মদের রমরমা করবার উৎখাত করে শিক্ষার আলোয় ফেরাতে হবে সমগ্র জনজাতিকে। আন্দোলনের নেতৃত্বে প্রমীলা বাহিনীর দুর্গা মালিক, বিদ্যা মালিক, করুণা মালিকেরা। সহযোগিতায় তৎকালীন প্রধান জয়দেব দোলুই সহ সমস্ত পঞ্চায়েত সদস্যরা।
আরও খবরের জন্য ক্লিক করুন… প্রতি মুহূর্তের লাইভ খবরের আপডেট পেতে ফলো করুন বিপ্লবী সব্যসাচী নিউজ
ঝটিতি খবর পেতে আমাদের WhatsApp গ্রুপে জয়েন করুন : Click Here
কয়েক বছরের লাগাতার চেষ্টায় অবশেষে চোলাই মদ তৈরির আতুর ঘর হিসেবে পরিচিত ওই গোপমহল এলাকার ৭০ – ৮০ টি পরিবার থেকে উৎখাত হলো চোলাই মদের করবার। একই সাথে এলাকার কচিকাঁচা সহ অন্যান্যদের শিক্ষার আলোয় ফেরাতে খোলা হয় অবৈতনিক বিদ্যাসাগর পাঠশালা। যেখানে একসময় চোলাই তৈরির কালো ধোঁয়া উঠত সেখানে শোনা যায় কচিকাঁচাদের পড়ার আওয়াজ। বই খাতা হাতে স্কুল মুখী হয়ে ওঠে সকল ছেলেমেয়েরা। শিক্ষা সংস্কৃতির ছোঁয়ায় এলাকার পোশাকি নাম হয়ে ওঠে বিদ্যাসাগর পল্লী। ২০১২ থেকে ২০২৪ এই ১২ বছরে আমূল পরিবর্তন এসেছে এই বিদ্যাসাগর পল্লীতে।
কোভিডের সময়কাল বাদ দিয়ে বিকল্প সংস্কৃতি নিয়ে দেবব্রত, পাপিয়া, সব্যসাচী, তাপস, পীযূষ, সঞ্জয়, প্রভা, সুরজিতের মতো একঝাঁক তরুণ-তরুণীরা স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে ওদের। বিদ্যাসাগর মিশনের পরিচালনায় তৈরি হয়েছে অবৈতনিক বিদ্যাসাগর পাঠশালা। সেখানে দায়িত্ব নিয়ে শিক্ষাদান করে চলেছেন পাপিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, লালমোহন শী, দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়েরা। চলছে কুসংস্কার বিরোধী চেতনার পাঠ, প্রকৃতি, পরিবেশ, পশু,পাখী সমেত মানুষকে ভালোবাসার শিক্ষাদান। চলছে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও মূল্যবোধ তৈরির শিক্ষা। এখানে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম সমেত বিভিন্ন মনীষীদের নিয়ে অনুষ্ঠান করা চলছে। পালিত হয় ভাষা দিবস। এমনকি একটি গ্রন্থাগার তৈরির প্রস্তুতিও সম্পন্ন। কিন্তু…। এই কিন্তুতেই লুকিয়ে রয়েছে একটা বড় লড়াই। অন্তরতদন্তে উঠে এসেছে নানান তথ্য। জানা গিয়েছে ২০১২ থেকে ২০২৪ এ পৌঁছাতে উদ্যোক্তাদের প্রচুর প্রতিবন্ধকতা পার করতে হয়েছে, এবং বর্তমানেও তা করতে হচ্ছেও।
“পড়ে কি হবে”! – এই মানসিকতার উপর দাঁড়িয়ে থাকা ওই এলাকার জনজাতির সাথে এবং পাশে থেকে তাঁদের হতাশাগ্রস্ত মনস্তাত্ত্বিকতা নিয়ে, দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ভেঙে উদক্তারা লড়াই করে চলেছেন, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কার, অপসংস্কৃতি, তরল রুচি, বাল্যবিবাহ, পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে। যেখানে দারিদ্র্য, সেখানে শিক্ষাদান তো বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ। তাই, শিক্ষা সামগ্রী প্রদানের সাথে সাথে নিয়মিতভাবে ভোকাল টনিক দিতে হয় ওদের গুণাবলী বিকাশের জন্য। এই বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর পল্লীর সুবিধাবঞ্চিত ছাত্রছাত্রীদের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন আলো-বাতাসযুক্ত একটা স্বতন্ত্র ও নিজস্ব কক্ষের, যেখানে রাখা থাকবে প্রচুর বইপত্র। গল্প-উপন্যাস-ছড়া-বিজ্ঞান-প্রবন্ধ-কমিক্সের বই। সন্দেশ-শুকতারা-আনন্দমেলা-সায়ন্তনীর মতো ম্যাগাজিন।
মননশীলতার চর্চা করবে ওরা। সুকুমার প্রবৃত্তিগুলোর সংরক্ষণ করতে শিখবে ওরা। মোবাইলের বিষাক্ত প্রভাব থেকে সরে গিয়ে ওরা আশ্রয় নেবে বাঁটুল দি গ্রেট, হাঁদাভোঁদা, নন্টে-ফন্টে, টিনটিন, অরণ্যদেবের ছায়াতলে। ওদের নিয়ে গড়ে উঠবে নাটকের দল। শিল্পের মধ্যে দিয়ে ওরা ছড়িয়ে দেবে জনসচেতনতার বার্তা। ওরা ফলের গাছ লাগাবে। ফুল ফুটলে মৌমাছি-প্রজাপতি আসবে, ফল খেতে পাখী আসবে। আর আসবে বসন্ত। মাঠের মধ্যে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে কল্পনাপ্রবণ হবে ওরা। পাখীর কূজন থেকে স্বাধীনতার অর্থ বুঝতে শিখবে। জ্যোৎস্নার জোনাকির কাছে শাশ্বত শান্তি অনুভব করবে। মুক্ত বিহঙ্গ থেকে মুক্তচিন্তা করতে শিখবে একদিন। জিজ্ঞাসু হবে।
আরও পড়ুন : হাসপাতালের বেডেই মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল চাঁদমণি
আরও পড়ুন : কোথাও এসকর্ট করে, কোথাও হুলা জ্বালিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্রে পৌঁছে দিলেন বনকর্মীরা
বিচার করে প্রশ্নের মাধ্যমেই গ্রহণ আর বর্জন করতে শিখবে এরা। আর ওদের স্বশিক্ষিত হতে সাহায্য করবে প্রকৃতি। কম্পিউটারে শিক্ষা নিয়ে ওরা পৃথিবীর কথা জানবে। শিখবে “বাসুধৈব কুটুম্বকম” –সারা পৃথিবী আমার পরিবার। জাতপাত ধর্ম বর্ণ দিয়ে মানুষকে বিচার না করে, মানুষ বলতে ওরা মানুষকেই বুঝবে। ওদের নিজেদের পাঠশালার কক্ষে রাখা থাকবে ফুটবল। টিউশন না গিয়ে বিকেলে খেলবে ওরা। শরীর সুস্থ থাকবে। ডোপামিনের নিঃসরনে মন আনন্দে ভরে যাবে। নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা তৈরি হবে। দাঁতে দাঁত চেপে লড়তে শিখবে ওরা। ওরা শিখবে জীবনে কোন কিছুই অপ্রয়োজনীয় নয়। স্বপ্নের মধ্যে মাটি-ঘামের গন্ধ লেগে থাকবে। প্রকৃত অর্থেই মানুষ হবে একদিন।
আসলে এই এক যুগের এক পরিবর্তিত চিত্রের মিল পাওয়া যায় বীরসিংহ এর স্মৃতি মঞ্চের দেয়ালে আঁকা এক ছবির সাথে। গত ১০ তারিখ বিকেলে বিদ্যাসাগর পল্লীর বিদ্যাসাগর পাঠশালাতে শুরু হলো নতুন বছরের পাঠ্যক্রম। আরো একটি বছরের পথ চলা শুরু। শুরুতেই বিদ্যাসাগরের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান এবং শ্রদ্ধা জানিয়ে সকলের উপস্থিতিতে অবৈতনিক পাঠশালায় পড়তে শুরু করলো প্রান্তিক দরিদ্র ছেলে মেয়েরা। এদিন দেবব্রত বাবু পাপিয়াদের জিজ্ঞেস করলাম , এ তো ইউটোপিয়া ওনারা উত্তর দিলেন, “আমরা মনে করি সমস্ত পৃথিবী একদিন ভালো মানুষের হবে। শোষনহীন সমাজ গড়ে উঠবে। প্রান্তিক, নিপিড়ীত মানুষের জন্য সাম্য আসবে সেদিন।
তাই এভাবেই মানবতা, মুক্তচিন্তার স্বাদ এদের দিয়ে যেতে চাই। অন্ধকারে একটা ছোট্ট প্রদীপ হলেও জ্বালিয়ে যেতে চাই। সেই প্রদীপের বলো নিশ্চয়ই কোনদিন সূর্য শিখা হয়ে আলো বিতরণ করবে। আই মে বি ডেস্ট্রাকটেড, বাট নেভার ডিফিটেড। এটাই আমার জীবন দর্শন। এই দর্শনের শিখায় আমি বিদ্যাসাগর পল্লীকে রাঙিয়ে যেতে চাই। বাকী কথা বলবে সময়। আমি আশাবাদী।” তাঁদের এই ভাবনার প্রতি সম্মান জানিয়ে অনেকেই জানিয়েছেন ‘একজন মানুষকে তখনই কৃত্রিত্বের অধিকারী বলা যায় যখন সে অন্যের কল্যাণ কর্মে কিছুটা সময় অতিবাহিত করতে পারে ‘।
আরও পড়ুন : ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্রে এবার অভিনেতা বনাম অভিনেতার লড়াই! জল্পনা তুঙ্গে
আরও পড়ুন : হুটার বাজিয়ে এসকর্ট করে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্রে পৌঁছাবে বনদপ্তর, থাকবে কড়া নজরদারি
লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ- https://www.facebook.com/biplabisabyasachi
Ghatal
– Biplabi Sabyasachi Largest Bengali Newspaper