ওয়েব ডেস্ক, বিপ্লবী সব্যসাচী পত্রিকা অনলাইন : তমলুক থেকে ১৬ কিলোমিটার পশ্চিমে কংসাবতী নদীর তীরে অবস্থিত এই প্রাচীন রাজপরিবার সম্পর্কে আজও প্রচলিত প্রবাদের মতো ছড়া, ‘ময়না রাজার মান, গজনা রাজার ধান। কুচল ঘোড়ই এর পাকা, দে নন্দের টাকা’।মহারাজ জগদানন্দ(১৭৭০খ্রীঃ – ১৭৭৩খ্রীঃ)-এর রাজত্বকালে ময়নাগড় রাজত্ব ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির হস্তগত হয়। জগদানন্দের সঙ্গে কোম্পানির লড়াইয়ের সময়ে লেফটেন্যান্ট রবার্ট বেইলির নেতৃত্বে ইংরেজ সেনা গড় আক্রমণ করে। কিন্তু সুরঙ্গপথে রাজা অন্যত্র চলে যাওয়ায় ইংরেজরা কেউই রাজার খোঁজ পায়নি।
আরও খবরের জন্য ক্লিক করুন… প্রতি মুহূর্তের লাইভ খবরের আপডেট পেতে ফলো করুন বিপ্লবী সব্যসাচী নিউজ
ঝটিতি খবর পেতে আমাদের WhatsApp গ্রুপে জয়েন করুন : Click Here
পরিবর্তে, রবার্ট বেইলির নেতৃত্বে প্রাসাদে যথেচ্ছ ভাঙচুর এবং লুটতরাজ চালানো হয়।রাজা জগদানন্দের রাজত্বকালেই ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ভয়াবহতা বাঙলাকে গ্রাস করে ফেলে।লিখিত। তাঁর পুত্র মহারাজ ব্রজানন্দের রাজত্বকালেই ওয়ারেন হেস্টিংস ‘পাঁচসালা’ এবং লর্ড কর্ণওয়ালিস ‘দশসালা’ ব্যবস্থার সূচনা করেন। ১৭৯১ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজসরকার, ময়নাগড় রাজাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ও মিথ্যা প্ররোচনায় তাঁদের জর্জরিত করে মাত্র “দেড় টাকা” খাজনা আনাদায়ে(কর ফাঁকি দেওয়ার দায়ে) তৎকালীন আমলে প্রায়, শতাধিক বিঘা জমি এবং পরগণার প্রায় ৫৬টি গ্রাম ইংরেজরা বলপূর্বক হস্তক্ষেপ করে নেয়!
রাজা ব্রজানন্দের মৃত্যুর পরে অবশিষ্ট ১০৫টি পরগণা সমন্বিত ময়নাগড় রাজত্ব বহু ছোটো ছোটো জমিদারী ও জায়গীরদারিতে বিভক্ত হয়ে যায়। ময়নাগড় একসময়ে ধর্মমঙ্গলের বীর লাউসেনের রাজধানী ছিল। লাউসেনের সঙ্গে ইতিহাসেরও যোগ আছে। গৌড়েশ্বর ধর্মপালের সেনাপতি কর্ণসেনের পুত্র লাউসেন। নগেন্দ্রনাথ বসু তাঁর ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস গ্রন্থে’ এ প্রসঙ্গ লিখেছেন। আবার মঙ্গলকাব্য অনুসারে লাউসেনের সঙ্গে কিংবদন্তীরও যোগ রয়েছে। ধর্মঠাকুরের কৃপায় পশ্চিমঘাটে সূর্যোদয় দেখিয়েছিলেন লাউসেন। তবে লাউসেনের পর পরিত্যক্ত এই গড় জলদস্যু শ্রীধর হুইয়ের দখলে যায়।
জলদস্যুর হাত থেকে ময়নাগড় উদ্ধারের পরে সামন্তরাজ গোবর্ধন মূল বসতবাড়ীটি কেন্দ্র করে চারদিকে দ্বিস্তরীয় ধাঁচে গভীর পরিখা খনন করান। অর্থাৎ, দ্বীপে অবস্থিত মূল রাজবাড়ীটি দু’টি পৃথক বর্গাকার পরিখা দ্বারা বেষ্টিত। এই পরিখা দুটি কালীদহ ও মাকড়দহ নামে পরিচিত। গড়বাড়ী সংলগ্ন পরিখা, কালীদহের একপাশের দৈর্ঘ্য ৭৫০ ফিট অর্থাৎ, গড়সমেত কালীদহের পরিমাপ ৫,৬২,৫০০ বর্গফিট। এর বাইরের পরিখা অর্থাৎ, মাকড়দহের একপাশের দৈর্ঘ্য ১,৪০০ ফিট। তাহলে সর্বমোট মাকড়দহ, কালীদহ সমেত গড়বাড়ীর জমির মাপ ১৯,৬০,০০০ বর্গফিট বা ৩০৭ বিঘা। সম্পূর্ণ গড়প্রাসাদটি কংসাবতীর মূলধারার সঙ্গে যুক্ত।
গড়ের ভিতরে বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন মন্দিরগুলির মধ্যে পনেরো শতাব্দীতে নির্মিত শ্রী শ্রী শ্যামসুন্দর জিউ মন্দির এবং ষোড়শ শতকের লোকেশ্বর জিউ মন্দির উল্লেখযোগ্য।রাসোৎসবের সময়ে এই ঘাটেই নৌকা বেঁধে শ্যামসুন্দর ও রাধারাণীকে নিয়ে যাওয়া হয় পরিখার মধ্যবর্তী আরেকটি দ্বীপে, যেখানে রাসমণ্ডপ প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। রাসপূর্ণিমার রাতে সারসার আলোকসজ্জিত নৌকায় শ্যামসুন্দর যখন পরিখায় জলকেলি করতে নামেন, তখন সে দৃশ্য সত্যিই অভাবনীয়! রাজা পূর্ণানন্দ বাহুবলীন্দ্র(১৮৬৩খ্রীঃ – ১৯৩৭খ্রীঃ)-এর রাজত্বকালে অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা হয়। ময়নাগড়েও তার প্রভাব এসে পড়ে। রাজা নিজেও স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন।
আরও পড়ুন : রেশমি মেটালিকস কারখানায় শ্রমিক মৃত্যুতে জাতীয় সড়ক অবরোধ বিজেপির
আরও পড়ুন : সময়সীমার আগেই বঙ্গে প্রবেশ বর্ষা কাল, আগামী দিনে বৃষ্টির পূর্বাভাস আবহাওয়া দফতরের
ময়নাকে কেন্দ্র করে সেবক সমিতি গঠন করা হয়। বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর এককালীন গোপন আস্তানা রূপে পূর্ব পর্বোল্লিখিত নাড়াজোল রাজবাড়ীর মতো ময়নাগড় রাজবাড়ীও পরিগণিত হতো। পরিখাঘেরা দ্বিগুণ সুরক্ষার কারণে বহুবার বহু দেশভক্ত বিপ্লবী এই রাজবাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছেন। দিনের পর দিন চলেছে সংগ্রামীদের অস্ত্র-প্রশিক্ষণ, সভার কার্য্যকলাপ। রাজা পূর্ণানন্দ বাহুবলীন্দ্রের বংশধর হেরম্বানন্দের আমলেই বাহুবলীন্দ্র পরিবার বিভিন্ন শরিকানায় বিভক্ত হয়ে যায়। ময়নার রাজপরিবার বাহুবলীন্দ্র বংশের বাসস্থান হিসাবেও যেমন ময়নাগড়ের গুরুত্ব রয়েছে, তেমনই এর গুরুত্ব ইতিহাস, মঙ্গলকাব্য, প্রবাদপ্রবচন সর্বত্র।
পরিখাবেষ্টিত এই গড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যও আকর্ষণীয়। এই ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণেই ময়নাগড়কে ২০০৬ সালে রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের তরফ থেকে “হেরিটেজ সাইট”-এর তকমা দেওয়া হয়। যদিও হেরিটেজ সাইটের স্বীকৃতি পেলেও আজ অব্দি ইতিহাস সংরক্ষণ সংক্রান্ত কোনো কাজই করা হয়নি বলে রাজপরিবার বা স্থানীয়দের তরফে অভিযোগও রয়েছে! বর্তমানে ময়নাগড়ে রাজবাড়ীর প্রাচীন অংশটি ভেঙে পড়লেও কিছুটা অংশ সংস্করণ করে বসবাসযোগ্য করা হয়েছে। সঙ্গে কয়েকজন শরিকানা বিভক্ত উত্তরসূরীদেরও বসতি নির্মিত হয়েছে। বংশীধারী শ্যামসুন্দর আজও ঐতিহাসিক রাজবংশের সুমহান ইতিহাসের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে শ্রীমতি রাধিকার সঙ্গে নিত্যপূজিত হচ্ছেন।
ময়নাগড় রাজ পরিবারের বর্তমান সদস্যদের যাতায়াতের জন্য ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা রয়েছে প্রত্যেক বাড়ির।প্রতিদিন দৈনন্দিন কাজে এই নৌকাগুলো তাদের যাতায়াতের প্রধান অবলম্বন। এ বিষয়ে রাজ পরিবারের বর্তমান সদস্য কৌশিক বাহুবলীন্দ্র জানান,অতীতের ঐতিহ্য এখনও বর্তমান ময়নাগড়ে।ময়নাগরে রাজ পরিবারের যাতায়াতের সদস্যদের জন্য প্রত্যেক বাড়ির নিজস্ব ঘাট রয়েছে আর ঘাটে বাঁধা থাকে নৌকো। ময়নাগড়ে প্রতিটি মানুষ এই ডিঙ্গি নৌকো চালাতে জানে। প্রতিদিন নৌকোয় করে পরিখার জল পথ পেরিয়ে যাতায়াত চলছে। এই ঐতিহ্য আগামীতেও বজায় থাকবে।’
আরও পড়ুন : ইসরোর দরবারে পিংলার সৌম্যদীপ! ভবিষ্যতে স্বপ্ন গবেষণার
আরও পড়ুন : পুরোনো মামলায় বিজেপির একাধিক নেতা কর্মীর বাড়িতে অভিযান পুলিশের
লাইক করুন আমাদের ফেসবুক পেজ- https://www.facebook.com/biplabisabyasachi
Paschim Medinipur
– Biplabi Sabyasachi Largest Bengali Newspaper