৩৩ তম বর্ষ, ৩২ সংখ্যা, ৪ঠা সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৮ ভাদ্র ১৪২৭
এক একজন মানুষ পৃথিবীতে আসেন অতি সাধারণভাবে। কিন্তু নিজেদের শ্রম, কর্মদক্ষতা ও অধ্যাবসায়ের গুণে একদিন না একদিন তাঁদেরই কেউ কেউ মহীরূহ হয়ে ওঠেন। ‘ভারতরত্ন’ প্রণব মুখোপাধ্যায়ও তাঁদেরই অন্যতম। বীরভূমের মিরিটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করে সাধারণভাবে পড়াশোনা শেষ করে কখনও করণিক, কখনও বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা থেকে কলেজে অধ্যাপনার পর একদিন তিনিই হয়ে উঠলেন ভারতীয় রাজনীতির এক স্তম্ভ। ইন্দিরা গান্ধীর সৌজন্যে একেবারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার উচ্চ ক্ষমতার বৃত্তে অবস্থান। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার ডান হাত হয়ে ওঠা, পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপন এবং কংগ্রেসের অন্যতম শীর্ষ নেতৃত্বে আরোহন সবই যেন প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জীবনে রূপকথার মতোই। রাজীব গান্ধীর সঙ্গে কোনও কারণে সুসম্পর্ক ভাঙে যাওয়ায় নিজের পৃথক দল গঠন করেও কোনও সুরাহা করতে পারেননি। ফলে পুনরায় কংগ্রেসে ফিরে এসে পুনরায় দলে নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে তোলেন তিনি। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। নিজের ক্ষুরধার মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে একেবারে মনমোহন সিঙ্ঘের সরকার পর্যন্ত কেন্দ্রের বিভিন্ন মন্ত্রকে অধিষ্ঠিত হয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ইন্দিরা থেকে মনমোহন সরকার পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্য মন্ত্রী, শিল্প মন্ত্রী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বা বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্ব পাওন করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। একসময় বিশ্বের সেরা অর্থমন্ত্রীর তকমাও অর্জন করেছিলেন। দীর্ঘকাল কংগ্রেসের বহু সংকটের মোকাবিলার দায়িত্ব পেয়ে তার সমাধানের পথ খুঁজে দিয়েছেন দলকে। তিনি কোনও দিনও দলের সর্বভারতীয় সভাপতি ছিলেন না। ছিলেন না প্রধানমন্ত্রী বা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও। তবুও সরকার কিংবা দলের দু’নম্বর স্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তোলার কৃতিত্ব অর্জন করেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তারপর? তারপর একদিন গোটা বাংলার মুখ উজ্জ্বল করে ২০১২-র ২৫ জুলাই একেবারে রাইসিনা হিলের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন। ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ। এই দীর্ঘ কর্ম্ময় জীবনে নানাদিকে নানা রত্ন মুকুটে ভূষণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন এই খর্বকায় বাঙালি। শেষ মেশ দিল্লির সেনা হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর দ্বৈরথে পরাজিত প্রণব। যাঁর সর্বপ্রথম পরিচয় ‘রাষ্ট্রপতি’ ও ভারতরত্ন। এই দুই শিরোপার মধ্য দিয়ে তিনি ভারতীয় ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেনই। দেশের রাজনীতির জগতে যিনি মহীরুহ হয়ে ওঠার সংগ্রাম মুখর জীবনের অনুপ্রেরণাও হয়ে থাকবেন বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতাদের কাছে। ১৯৩৫ এর ১১ ডিসেম্বর যার পৃথিবীর প্রথম আলো দেখা, দীর্ঘ প্রায় সাড়ে আট দশক বাদের চিরকালের জন্য মুছে গেল সেই আলোকস্তম্ভ ২০২০র ৩১ আগষ্ট। সত্যিই, তাঁর প্রয়ান ভারতীয় রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতির এক বড় ক্ষতি।